মঙ্গলে প্রাচীন জীবনের ইশারা: পারসিভিয়ারেন্সের নতুন নমুনা নিয়ে চাঞ্চল্য
নাসার রোভার পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলগ্রহের জেজেরো ক্রেটারের একটি শুকনো নদীপথে কাজ করতে গিয়ে নতুন কিছু চিহ্ন পেয়েছে। এই চিহ্নগুলো দেখাচ্ছে—মঙ্গলে বহু আগেকার এক সময়ে ক্ষুদ্র জীব ছিল কি না, তার সম্ভাবনা বেশ জোরালো। রোভারটি “ব্রাইট অ্যাঞ্জেল” নামে পরিচিত এলাকায় চেয়াভা ফলস নামের একটি তীরের মতো দেখতে শিলায় ছিদ্র করে “স্যাফায়ার ক্যানিয়ন” নামে নমুনা তোলে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফল খুব আশাব্যঞ্জক; তবে এখনই “জীবন মিলেছে” বলা যাবে না। আরও পরীক্ষা দরকার।
নতুন নমুনায় এমন কিছু খনিজ মিলেছে, যেগুলো পৃথিবীতে সাধারণত পানিভিত্তিক পরিবেশে তৈরি হয় এবং অনেক সময় জীবাণুর কাজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। এর মধ্যে ভিভিয়ানাইট (লোহা-ফসফেট) আর গ্রেইগাইট (লোহা-সালফাইড) উল্লেখযোগ্য। এগুলো দেখা গেলে জীবনের সম্ভাবনা বাড়ে, কিন্তু অজৈব (শুধু পাথর-জল–তাপের) প্রক্রিয়াতেও তৈরি হতে পারে। তাই এই চিহ্নগুলোকে বিজ্ঞানীরা “সম্ভাব্য বায়োসিগনেচার”—মানে জীবনের ইঙ্গিত—হিসেবে দেখছেন। নিশ্চিত হতে আরও খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ দরকার।
এই জায়গাটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? জেজেরো ক্রেটার একসময় বিশাল এক হ্রদ আর নদীর ডেল্টা ছিল—এমন প্রমাণ আগে থেকেই পাওয়া গেছে। পানির উপস্থিতি দীর্ঘ সময় ছিল বলেই সেখানে কাদা-পাথর ও লবণযুক্ত স্তর জমেছে; এমন স্তর সাধারণত প্রাচীন সময়ের দাগ বা অণুজীবের চিহ্ন ভালোভাবে ধরে রাখে। সাম্প্রতিক গবেষণায় রোভারটির ভূগর্ভ দেখার রাডারও প্রাচীন হ্রদ–ডেল্টার ইঙ্গিত জোরালো করেছে। ফলে এখানকার নমুনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা বেশি।
রোভারটি ঠিক কী দিয়ে এসব দেখছে? এর কাছে কয়েকটি বিশেষ যন্ত্র আছে—PIXL (ক্ষুদ্র অংশে উপাদান মাপে), SHERLOC (লেज़ার–রামান ও ফ্লুরোসেন্স দিয়ে জৈব অণুর ইশারা খোঁজে), SuperCam (লেज़ার দিয়ে দূরের পাথর পরীক্ষা করে) আর Mastcam-Z (জুম ক্যামেরা)। এসব যন্ত্র একসঙ্গে শিলার গঠন, রাসায়নিক মানচিত্র আর সূক্ষ্ম উজ্জ্বলতা বিশ্লেষণ করে। তাই ছোট্ট দাগ বা রেখাতেও অনেক তথ্য মিলছে।
“বায়োসিগনেচার” কথাটার সহজ মানে কী? এমন কোনো চিহ্ন—উপাদান, অণু, গঠন বা প্যাটার্ন—যেটা সাধারণত জীব ছাড়া তৈরি হয় না। যেমন, কিছু ধরন의 জৈব-অণু, খনিজের বিশেষ বিন্যাস, কিংবা সূক্ষ্ম স্তরবিন্যাস। তবে মহাকাশে শুধু একটা লক্ষণ দেখলেই চলবে না; ভুল-ইতিবাচকও হতে পারে। তাই একাধিক প্রমাণ মিলিয়ে দেখতে হয়।
এখানেই আসে নমুনা ফেরানোর কথা। মঙ্গল থেকে এই কোর নমুনা পৃথিবীতে আনা গেলে অত্যাধুনিক ল্যাবে অনেক গভীর পরীক্ষা করা সম্ভব হবে—আইসোটোপ (কার্বনের ভেতরের ভারী–হালকা অনুপাত), মাইক্রোস্কোপে অতি-সূক্ষ্ম গঠন, খনিজের ভিতরের স্তর—সবকিছু। নাসা–ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা মিলে যে মার্স স্যাম্পল রিটার্ন পরিকল্পনা করছে, সেটার লক্ষ্যই এসব নমুনা নিরাপদে পৃথিবীতে পৌঁছে দেওয়া। সময়সূচি ও নকশা নিয়ে আলোচনা চলছে, কিন্তু লক্ষ্য একই—নমুনা ফিরিয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে যাওয়া।
এদিকে পারসিভিয়ারেন্স এক জায়গায় থেমে নেই। জেজেরোর নদীপথ নেরেটভা ভ্যালিস ধরে এগিয়ে নতুন নতুন শিলা খুঁজছে। “চেয়াভা ফলস”-এর পাশে যে নমুনা তোলা হয়েছে, তার ছবি ও অবস্থান নাসা বিস্তারিত দেখিয়েছে। একই এলাকায় আরও কিছু নমুনা সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে, যাতে বিভিন্ন স্তরের তুলনা করা যায়—কখন কোথায় পানি ছিল, কত দিন ছিল, রসায়ন কতটা বদলেছে ইত্যাদি।
অবশ্য বিজ্ঞানীরা সতর্ক। কারণ, ভিভিয়ানাইট বা গ্রেইগাইটের মতো খনিজ জীবাণু থাকলেও তৈরি হতে পারে, আবার জীবাণু ছাড়াও তৈরি হতে পারে। তাই “সম্ভাব্য জীবনের চিহ্ন” বলতে তারা বুঝাচ্ছেন—এগুলো জীবনের দিকেই ইশারা করে, কিন্তু একে একাই বিচার শেষ নয়। বিভিন্ন প্রমাণ একসঙ্গে মিললে তবেই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা যাবে। এই সতর্কতা বিজ্ঞানচর্চারই অংশ।
তাহলে এখনকার চিত্রটা কী? সহজ করে বললে—(১) জেজেরো ক্রেটার একসময় হ্রদ–ডেল্টা ছিল; (২) সেখানে পানির দাগ, কাদা-পাথর, লবণ—সবই আছে; (৩) নতুন নমুনায় এমন খনিজ ও জৈব সংকেত মিলেছে, যা জীবনের সঙ্গে খাপে খাপে মেলে; (৪) কিন্তু নিশ্চয়তা পেতে নমুনা পৃথিবীতে এনে গভীর পরীক্ষা দরকার। এই চারটি পয়েন্টই পুরো খবরের সার।
যদি একদিন প্রমাণ হয়—এই চিহ্নগুলি সত্যিই প্রাচীন জীবের ছাপ—তাহলে সেটা হবে আমাদের সৌরজগত গবেষণার বড় মাইলফলক। আর যদি শেষে বোঝা যায়—সবই অজৈব প্রক্রিয়ার ফল—তবু লাভ কম নয়; এতে মঙ্গলের পানি, আবহাওয়া আর শিলার ইতিহাস অনেক পরিষ্কার হবে। তাই বিজ্ঞানীরা ধৈর্য নিয়ে এগোচ্ছেন। আমরা যারা খবর পড়ছি, তারা এটুকু মনে রাখি—এটা কোনো চটজলদি ঘোষণা নয়; বরং ধাপে ধাপে যাচাইয়ের পথ। শেষ কথাটা বলবে ল্যাবের পরীক্ষাই।