মহাবিশ্বে গ্রহজন্ম কীভাবে ঘটে—এ প্রশ্নের জবাবে বিরল কিন্তু ঐতিহাসিক এক সাফল্য মিলেছে। আন্তর্জাতিক একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির (ESO) ভেরি লার্জ টেলিস্কোপে (VLT) একটি তরুণ সূর্যসদৃশ নক্ষত্রকে ঘিরে থাকা বহু-রিং-যুক্ত ধূলি-গ্যাসের ডিস্কের ফাঁকে একটি নবজাতক গ্রহকে সরাসরি ইমেজ করেছেন। গ্রহটির নাম দেওয়া হয়েছে WISPIT 2b—এটি মাত্র প্রায় পাঁচ মিলিয়ন বছর বয়সী; আকারে বৃহস্পতি-সদৃশ, ভরে আনুমানিক তার চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি। এই কাজটি The Astrophysical Journal Letters-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং কোনো ‘গুজব’ বা সামাজিক-মাধ্যমভিত্তিক দাবি নয়—সম্পূর্ণ সহকর্মী-সমীক্ষিত (peer-reviewed) গবেষণা।
গবেষকেরা প্রথমে বহু তরুণ নক্ষত্রকে খুব স্বল্প-সময়ের “স্ন্যাপশট” পর্যবেক্ষণে দেখেছিলেন যে WISPIT 2 নামের নক্ষত্রটির চারপাশে এক অনন্য মাল্টি-রিংড ডিস্ক রয়েছে। পরের ধাপে উচ্চতর সংবেদনশীলতায় ডিস্কের এক ফাঁকে একটি ক্ষীণ আলোর বিন্দু ধরা পড়ে—যা কেবল ধূলির গুচ্ছ নয়, আসলেই একটি কিশোর গ্রহ কিনা যাচাই করতে দলটি দ্রুত ফলো-আপ পর্যবেক্ষণ শুরু করে। বিশ্লেষণে নিশ্চিত হয়: ডিস্কের ওই ফাঁকে যে বিন্দুটি দেখা গেছে সেটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে—অর্থাৎ সেটি গ্রহ। আরও চমকপ্রদ হলো, এটাই বহু-রিং ডিস্কে প্রথম নির্ভুল (unambiguous) গ্রহ শনাক্তকরণ, যা গ্রহ-ডিস্ক মিথস্ক্রিয়ার সরাসরি প্রমাণ দেখায়।
শুধু ইনফ্রারেড নয়, দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে-ও গ্রহটির চিহ্ন মিলে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার বিশেষায়িত ম্যাগএও-এক্স (MagAO-X) যন্ত্রে এইচ-আলফা (H-α) নির্দিষ্ট রঙে উজ্জ্বলতা ধরা পড়েছে—যা বলে, গ্রহটি এখনো আশপাশের গ্যাস টেনে নিচ্ছে, অর্থাৎ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। এই দ্বিমুখী প্রমাণ (ইনফ্রারেড ইমেজিং + H-α এমিশন) মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা জানান, WISPIT 2b কেবল ডিস্কে থাকা এক টুকরো গুচ্ছ নয়, বরং নিজ কক্ষপথে ঘুরতে থাকা একটি প্রকৃত প্রোটোপ্ল্যানেট।
বিজ্ঞানভাবনার দিক থেকে এর তাৎপর্য কয়েকটি স্তরে। প্রথমত, গ্রহ-জন্মের রিয়েল-টাইম দৃশ্য ধরা পড়ল—যা কম্পিউটার মডেল বা পরোক্ষ সংকেতে আন্দাজ না করে, সরাসরি ডেটা দিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ডিস্কের রিং-এবং-গ্যাপ নমুনা যে গ্রহ-চালিত, সে ব্যাখ্যাটি শক্ত হলো। তৃতীয়ত, তরুণ সূর্যসদৃশ নক্ষত্রের চারপাশে এত স্পষ্টভাবে ধরা পড়া এই বেবি-প্ল্যানেট ভবিষ্যতে বায়ুমণ্ডল গঠনের সূচনা, কক্ষপথ স্থায়ী হওয়ার পদার্থবিদ্যা এবং ডিস্ক-গ্রহ যৌথ বিবর্তন—সবই যাচাইয়ের পরীক্ষাগার।
এমনকি সাধারণ পাঠকের জন্যও এই খবরের সৌন্দর্য আছে। কল্পনা করুন: আমাদের সৌরজগতের জন্মের প্রথম কয়েক মিলিয়ন বছর—যখন বৃহস্পতি-শনি-ইত্যাদি গ্যাস জায়ান্টরা আশপাশের পদার্থ ‘খেয়ে’ আকার নিচ্ছিল। WISPIT 2b-কে দেখে যেন সেই শৈশবের জানালা একটু খুলে গেল। গবেষকেরা জানিয়েছেন, ইনফ্রারেড ছবিতে গ্রহটি নিজের তরুণ তাপ থেকে ঝলমল করছে; আবার H-α রেখায় এটিকে ‘গ্যাস-খেকো’ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এই মিলিত ছবি ভবিষ্যতে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, এলএমএ (ALMA)-র সাবমিলিমিটার পর্যবেক্ষণ এবং আরও উচ্চ-কনট্রাস্ট ইমেজিং দিয়ে পরবর্তী ধাপের বিশ্লেষণকে গতিময় করবে।
সবচেয়ে আশ্বাসজনক দিক—এটি যাচাই-করা, প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক ফল। ইউনিভার্সিটি অব গালওয়ে, লেইডেন ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা নেতৃত্বে হওয়া এই কাজের প্রেস রিলিজ/সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের দিনই প্রকাশিত হয়েছে; ফলে তথ্য মিলিয়ে দেখা সহজ। তাই সামাজিক-মাধ্যমে ছড়ানো অনিশ্চিত নাম বা পুরনো টেলিস্কোপের গল্পের মতো নয়—WISPIT 2b-এর খবর প্রমাণ-সমর্থিত।